যে গল্পটা কেবল তিনজন জানে
জুরাইন কবরস্থান থেকে টানা দশ মিনিট হাঁটলে আমাদের গল্পের প্রধান ও একমাত্র চরিত্রের দেখা পাওয়া যাবে। আফসানা নিবাসের তৃতীয় তলায় থাকে সে। পুরো এলাকায় যখন কোনো বাড়িওয়ালা ব্যাচেলর ভাড়া দিচ্ছিল না, তখন কোন মন্ত্রবলে দিদার আফসানা নিবাসের মালিক সুলতান সাহেবেকে রাজি করিয়েছিল, সেটা হয়তো আমরা এই গল্প জানতে পারবো না। তবে ঠিক এই মুহুর্তে ধড়ফড় করে দিদারের ঘুম থেকে ওঠার খবর আমরা জানতে পারবো। আমরা দেখতে পাবো দিদার ঘুম থেকে উঠেই নাক ছোক ছোক করছে এবং কোনো একটা গন্ধ বা ঘ্রাণের উৎস খুঁজছে। একটু পরেই দিদারের ওক টানা দেখে আমরা নিশ্চিত হবো ঘ্রাণ নয় বরং গন্ধের উৎস খুঁজছে সে। দিদারের ফ্ল্যাটে মোট তিনটে রুম। সবগুলো রুম ফাঁকা। কেবল যেই রুমে দিদার শুয়ে আছে সেই রুমে একটা তোশক, তিনটে বালিশ এবং বড় একটা ব্যাগ দেখতে পাবো। আমরা দেখতে পাবো সব রুমের মেঝেতে সরু একটা দাগ চারকোণা করে পুরো রুমকে আটকে দিয়েছে। এই সময়ে দিদার ব্ল্যাক ম্যাজিক করে কিনা চিন্তা করার আগেই দেখবো ইঁদুর, তেলাপোকা মারার চকের একটা ছেঁড়া প্যাকেট পড়ে আছে মাঝখানের রুমে। আমাদের গল্পে অরু, লাবণী, ফাতিহাসহ আরো কিছু চরিত্র থাকতে পারতো। এদের সবাইকে পৃথক পৃথক সময়ে এই ফ্ল্যাটে আসতে দেখেছে সুলতান সাহেবের একমাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক বাক প্রতিবন্ধী ছেলেটা। দিদার বিষয়টা জানলেও তেমন মাথাব্যথা তার না থাকায় আমরা বিষয়টা নিয়ে আর কথা বলছি না। বাড়িওয়ালা সুলতান সাহেব গত তিন মাসে মোট চারবার এই ফ্ল্যাটের দরজায় আসলেও ভেতরে উঁকি দেননি নাকি সাহস পাননি—সেটাও আমাদের দেখবার বিষয় না। কারণ একটু পরেই আমরা দেখবো দিদার নাক চেপে ধরে উঠে বসেছে। গন্ধের তীব্রতায় সে আর টিকতে পারছে না। আগামী মিনিট দশেক দিদার হন্যে হয়ে পুরো ফ্ল্যাট তন্ন তন্ন করে গন্ধের উৎস খুঁজবে। রান্না ঘরে একটা আধখাওয়া বনরুটি আর বারান্দার তিনটে সিগারেটের ফিল্টার ছাড়া খুঁজে না পেয়ে আবারো নাক চেপে ধরে বসে পড়বে তোশকের উপর। বালিশের নিচে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে যখন দেখবে সিগারেট শেষ তখন বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে। বাইরে যাওয়ার পথে দিদার আফসানা নিবাসের সিঁড়ি, নিবাসের গেট এবং রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা আট ফুট দেয়ালের সামনের ভাগ ছোক ছোক করে শুঁকে দেখেবে। এর একটু পর আমরা দেখতে পাবো এলাকার ছোট্ট চা বিড়ির দোকানের সামনে নাক চেপে দাঁড়িয়ে থাকা দিদারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দোকানদার বজলুর বিস্মিত দুটো চোখ। ঠিক এই রকম চোখেই সুলতান সাহেবের ছেলে দুই তলার বারান্দা থেকে দিদারের দিকে তাকিয়ে থাকে সেটাও আমরা জানবো একটু পর। সিগারেট কিনে বাসায় সরাসরি না এসে দিদার নাক চেপে ধরেই জুরাইন কবরস্থানের দিকে হাঁটা শুরু করবে। টানা দশ মিনিট হেঁটে কবরস্থানে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত দিদার রাস্তায় শুধু গন্ধের উৎস খুঁজবে। কবরস্থানের গেট থেকে একটু সামনে থাকা অস্থায়ী ডাস্টবিনের সামনে এসে দিদার বসে পড়বে। দিদারকে ময়লা হাতে নিয়ে শুকে শুকে মাথা নাড়াতে দেখে গেটে বসে থাকা দারোয়ান, তিনজন ফকির ও একটা কুকুর সুলতান সাহেবের ছেলের মতোন তাকিয়ে থাকবে। ডাস্টবিনের সামনে বসেই যখন দিদার একসাথে পাঁচ জোড়া চোখ দেখতে পাবে তখন তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াবে, যেভাবে উঠে বসেছিল বিছানা থেকে। দিদার কবরস্থানের পুরনো অংশে ঢুকে পড়বে এবং আরো পনেরো মিনিট পর একটা গাছের ডাল হাতে বের হবে। গাছের ডালে ছয়টা কদমফুল দেখে আমরা বুঝতে পারবো এখন বর্ষাকাল। কদম ফুলগুলো নাকে চেপে ধরে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করার সময় দিদার ভুলে যাবে কদম ফুলের কোনো ঘ্রাণ হয় না। সিগারেট আর কদমের ডাল হাতে আফসানা নিবাসে ঢোকার সময় রাস্তা থেকে দিদার দেখবে সুলতান সাহেবের একমাত্র ছেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দিদার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কিছু একটা বলতে বলতে আফসানা নিবাসের ভিতর ঢুকে যাবে। একটু খেয়াল করে শুনলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম দিদার বলছিল, “বালের এলাকা, বালের ঢাকা। দুই মিনিট বৃষ্টি হইলেই গুয়ের গন্ধে ভাইসা যাওয়া শুরু করে।” দিদারের কথা না শুনতে পেলেও আমরা জানি আজকে সারাদিন কোনো বৃষ্টি হয়নি। আকাশ যদিও এখন মেঘলা। তবে এর ঠিক ত্রিশ মিনিট পরে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হবে। তখন দিদারকে আমরা দেখতে পাবো নাকে একটা গামছা বেঁধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে। দিদারকে এভাবে সিগারেট ফুঁকতে দেখে পাশের বিল্ডিংয়ের দশ বছর বয়সী মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। বৃষ্টির ঝাটের ভিতর দিয়ে দিদারকে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে, যেভাবে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার দিদারের বারান্দায় এলেমেলো নারী কাপড় দেখতে পায় সে। বৃষ্টি থেমে যাওয়া পর্যন্ত দিদারকে আমরা বারান্দায় দেখতে পাবো। এরপর আবারো অস্থির চিত্তে পায়চারি করবে সে। বাথরুমে ঢুকে হড়হড় করে দিদার কতবার বমি করবে আজ রাতে সেই হিসাব আমরা দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। পুরোটা রাত দিদারকে কাতরাতে দেখবো আমরা। শেষ রাতের দিকে দিদারের মনে পড়বে আনজিলাকে কল দেয়া হয়নি। মোবাইল বের করে আনজিলাকে কল দেয়ার বদলে তার সহকারী হারুনকে কল করবে। তারপর একটু নিচু গলায় যেসব কথা বলবে তার অধিকাংশই অকথ্য। আমরা কেবল বলতে পারি দিদার গত সপ্তাহে লাশ কই ফেলছে সেটার খবর জানতে চাইবে। হারুন তার হিসাব ঠিকঠাক মতো দিলেও দিদার বারবার একই প্রশ্ন করবে। কলের শেষ দিকে হারুনের ‘আপনার কি হইছে ওস্তাদ? ঠিকাছেন তো?’ এর উত্তরে দিদার বলবে, ‘ না, আমি ঠিক নাই মাদারচোদ। বিকাল থিকা গুয়ের গন্ধ না মুতের গন্ধ শুধু শুধু নাকে আইতেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারতেছি না। নাড়িভুড়ি উল্টায়া আসতেছে।’ এরপর হারুন কিছু বলার আগেই দিদার কল কেটে দিবে। তারপর বড় ব্যাগটা খোলার পর আমরা দেখতে পাবো ব্যাগের ভিতর অসংখ্য মেয়েলি কাপড়। প্রত্যেকটার সাথে ছোট্ট করে নাম সেঁটে দেয়া। দিদার সিরিয়াল কিলার, অর্গ্যান পাচারকারী নাকি সাইকো সেটা জানার আগেই আমরা দেখবো দিদারের মুখে হাসি। নাক চেপে ধরে সে বারান্দার দিকে এগিয়ে যাবে। আমরা তখন জানবো দিদার গন্ধের উৎস খুঁজে পেয়েছে। বারান্দা থেকে আসা এক চিলতে বাসাতে গন্ধের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছে। সেই ভকভক করা গন্ধের অনুসন্ধানে অতি উত্তেজনায় দরজা খোলা রেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে দিদার। গেটের ঠিক সামনেই একটা মিনি ডাস্টবিন। বিকাল থেকে এই ডাস্টবিনটা চোখে পড়ে নাই বলে নিজেকে কয়েকবার গালি দিবে সে। আমরা দেখতে পাবো ডাস্টবিনের ঠিক সামনে এসে পাথরের মতো জমে যাবে দিদার। একটা ছোট্ট কুকুর ছানা কুঁই কুঁই করে কিছু একটা বের আনছে ময়লার স্তুপ থেকে। দিদারের সাথে আমরাও দেখবো কুকুর ছানাটি তার শরীরের থেকে বড়ো যেই বস্তুটি টেনে বের করেছে সেটা একটা মানুষের ছিন্ন মস্তক। এর দুই বা তিনদিন পর জুরাইনের সবাই এবং এক সপ্তাহের ভিতর পুরো বাংলাদেশের মানুষ দিদারের আসল পরিচয় জেনে যাবে। সাংবাদিক, পুলিশ এবং গত তিনমাসে নিখোঁজ হওয়া মেয়েদের স্বজনরা এসে আফসানা নিবাসের সামনে এসে ভিড় জমাবে। সুলতান সাহেবকে নাম পরিচয়হীন এক খুনিকে বাসা ভাড়া দেয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হবে। এলাকার সবাই তখন নিয়মিত বলতে থাকবে, ওই ছেলেটার যে সমস্যা আছে সেটা তারা আগেই বুঝতে পেরেছিল। কেবল পাশের বিল্ডিংয়ের দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটি, সুলতান সাহেবের ছেলে এবং কুকুর ছানাটি ছাড়া কেউ জানবে না দিদার কোথায়। কারণ সেই রাতে নিজের ছিন্ন মস্তক ডাস্টবিনের ভিতরে দেখে দিদার কিভাবে মাটির ভিতর ঢুকে গিয়েছিল সেটা ওরা ছাড়া কেউ জানে না।
0 Comments