খরস্রোতা ও খবর
ভিড়টা বাড়ে মূলত সন্ধ্যার পর। ভরদুপুরেও যে মানুষ কম থাকে তা কিন্তু না। সকাল সকাল আসলেও দেখা যাবে জনা বিশেক মানুষ দ্রুত পায়ে হাঁটছে। বিচিত্র ভঙ্গিতে সেসব হাঁটাকে নাগরিক ভাষায় বলে ‘মর্নিং ওয়াক’। নতুন এই পার্কটা হওয়ার পর থেকে নতুন নতুন যেসব জিনিস মফস্বলের এই ছোট্ট শহরে আমদানি হচ্ছে তার ভেতর এই মর্নিং ওয়াক অন্যতম। এসব জিনিস যে এই শহরে ছিল না এমনটা না। বড় রাস্তা ধরে নতুন বাজারের দিকে যেতে খোলা যেই মাঠটা সেখানেও কেউ কেউ হাঁটতে আর শরীরচর্চা করতে যেত, পুরনো ঘাটের পেছনটায় অথবা কলেজ মাঠেও দেখা যেত কাউকে কাউকে। পার্কটা হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী মানুষগুলো একসাথে হয়েছে। তবে যাই বলেন, সকাল সকাল একপাল মানুষ একসাথে দৌড়াচ্ছে—বিষয়টা দেখতে কিন্তু ভালোই লাগে।
মর্নি ওয়াকের মতো এই শহরে প্রেমও ছিল। কপোত-কপোতিরা শহরের বিভিন্ন নির্জন জায়গায় বসে প্রেম বিনিময় করত। ছিল স্কুল পালানো দুষ্টু ছেলেদের দল। পার্কটা হওয়ার কারণে এরা সবাই এখন একত্র হয়েছে। আজকাল ভরদুপুরে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে উদাস মনে বসে থাকে কয়েকটা ছেলে। পার্কের শেষদিকের বেঞ্চগুলোতে দেখা যায় প্রেমিকার কপট রাগ ভাঙাতে অনবরত চেষ্টা করে যাওয়া অবুঝ প্রেমিকদের। মর্নিং ওয়াক এবং স্কুল বাংক দেওয়া জনগোষ্ঠীর পার্কে আসার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকলেও এই প্রেমিক বা প্রেমিকা সমাজের কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই। এরা কেউ সেই সাত সকালে আসে, কেউ ভরদুপুরে বা বিকালে। তবে সন্ধ্যার পর তাদের আনাগোনা একটু বেশি দেখা যায়। অন্ধকারের সাথে প্রেমের একটি অন্যরকম সংযোগ আছে কি-না। সন্ধ্যার পর নতুন আরেক শ্রেণীর উদ্ভব হয় এখানে। শহরের মানুষেরা এখনও কোনো সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এদের ব্যাপারে। ঠিক কী নামে ডাকা যায় এদের? সন্ধ্যার পর পার্কে ‘পট’ করতে আসে তারা। মুরুব্বিরা এখনও এই ব্যাপারে সন্দিহান। পট জিনিসটা কী এখনও বুঝতে পারছে না তারা। পট মানে কী পটল তোলা? হতেও পারে।
সচারচার এরকম পার্কের সুন্দর একটা নাম থাকে। কিন্তু এই পার্কের কোনো সুন্দর ও একক নাম নেই। কেউ বলে ‘নতুন পার্ক’ কেউ বলে ‘বন্দর পার্ক’ কেউবা বলে ‘পল্টুন পার্ক’। আশাকরি বিষয়টা ধরতে পেরেছেন। হ্যাঁ, পার্কটার অবস্থান নদীর তীরে। নদীর নামেই এই শহরের নাম—খরস্রোতা। কতকাল আগে কে বা কারা এই নামে নদীকে ডেকেছিল… তারও বা কতকাল পরে একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল নদীর তীরে, সেইসব ইতিহাস আমরা আওড়াতে চাই না। নদী কিভাবে মানবসভ্যতা তৈরিতে সাহায্য করে সেটাও আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। মফস্বল শহর খরস্রোতা ও তার পাশঘেঁষে বয়ে যাওয়া সমনামের নদীটিও আমাদের আলাপে আসত না, যদি না পার্কটিকে পল্টুন পার্ক বা বন্দর পার্ক বলে কেউ না ডাকত। পুরনো লোহা-লক্কড়ের জঞ্জাল সরিয়ে যেখানে পার্কটা বানানো হয়েছে, সেখানে নাকি বন্দর ছিল। জাহাজ আসত নাকি রকেট? স্টিমার, লঞ্চ? মুরুব্বিরা উত্তর দিতে পারেন না। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পূর্বপুরুষের কথা বলে। বেশ আগে এই নদীতে জোয়ার ছিল। পাশের জেলায় একটা বাঁধ তৈরি করার কারণে কমে গেছে পানি, বদলে গেছে নদী ও জনপদের নাম। অতীতের সাগরে সাঁতার না কেটে আমরা বরং বর্তমানে ফিরি। ও হ্যাঁ, আজ পহেলা জৈষ্ঠ্য। এখন সময় সন্ধ্যা সাতটা তিরিশ মিনিট। তাহলে গল্পটা শুরু করা যাক, নাকি…
মৃদু কেঁপে উঠল নদী তীরের ছোট্ট পার্কটা। একবার, দুইবার… বারবার। পার্কের শেষদিকের লোহার জঞ্জাল জমিয়ে রাখা স্তুপের পেছনে আদিম আনন্দে মত্ত পারভিন প্রথম আঁচ করতে পারল কাঁপুনি। দুই ঠোঁটের মাঝখানে উড়না চেপে ধরে কম্পমান স্বরে সঙ্গী রাজুকে পারভিন বলেছিল—আস্তে, আস্তে। মুখে বিজয়ীর হাসি ঝুলিয়ে কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল রাজু। তবুও, কাঁপতে লাগল পার্ক, বারবার। এক ঝটকায় রাজুকে সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল পারভিন। এই কাঁপুনি রাজুর জন্য নয়, অন্যকিছু হচ্ছে। লোহার জঞ্জাল পার হয়ে আরো খানিকটা বায়ে নদীর পাড় ঘেঁষে বানানো রেলিং এর উপর পা ঝুলিয়ে মহাকাশে বিচরণ করছিল রিফাত, হাসিব আর জয়নাল। এরা তিনজন কখনও একত্রে, কখনও বা স্বতন্ত্রভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল সৌরজগতের বিস্তির্ণ কক্ষপথে। হাসিবই প্রথম ধরতে পারল বিষয়টা। সংঘর্ষ হচ্ছে নেপচুন আর প্লুটোর মধ্যে। কেঁপে উঠছে পুরো পৃথিবী। রিফাতের মনে হলো মহাকাশ ধরে কেউ ঝাঁকি দিচ্ছে অনবরত। সেই ঝাঁকিতে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে সব তারা। জয়নাল ছিল মহাকাশ ও পৃথিবীর মাঝামাঝি স্থানে। প্রথম কম্পনের পরেই পৃথিবীতে নেমে এলো সে। চোখ কচলে আলো-আঁধারির ভেতর দেখল মহাকাশ নয় বরং পার্কটাই দুলছে।
পার্কে আরো ছিলো সুলতান আহমেদ ও তার ছোট ভাবি নুপুর। সুলতান আহমেদ ঢাকা থেকে খরস্রোতায় এসেছে গত পরশু। তার ফুফাতো ভাই নাঈমের বাসায় বেড়াতে এসেছে সে। নাঈম অনেকদিন পর পয়সাওয়ালা মামাতো ভাইকে দেখে খুশি হয়েছে। নাঈমের নানার বংশে সব থেকে বেশি পয়সা বানিয়েছে সুলতান। ঢাকায় কীসের যেন ব্যাবসা করে। নাঈমের মনে একটাবারের জন্যও খটকা লাগেনি, মনে প্রশ্ন জাগেনি হুট করে সুলতান তার বাসায় কেন এসেছে। ভাইকে দেখে সে বরং খুশিই হয়েছে, ঢাকায় নিজের একটা ব্যাবস্থা করার কথা খুব দ্রুতই ভাইয়ের কানে তুলবে সে, কবে এবং কীভাবে তুলবে সেটার প্রস্তুতি নিতে নিতেই সময় যাচ্ছে তার। তার সুন্দরী বউ নুপুর এবং তার পয়সাওয়ালা ভাই সুলতান যে এখন পার্কে বসে বসে বাদাম খাচ্ছে, সেই খবর নেই নাঈমের কাছে।
প্লাস্টিকের ছাতাওয়ালা একটা টেবিলে বসেছিল নুপুর ও সুলতান। অনেক্ষণ মুখোমুখি বসে থাকার পর হুট করেই টেবিলের তলদেশ থেকে নুপুরের পায়ে আলতো করে খোঁচা দেয় সুলতান। আড়ষ্ট নুপুর পা পিছিয়ে নিতে চায় কিন্তু পারে না। সুলতান এবার আস্তে আস্তে উপরের দিকে ওঠাতে থাকে পা। নুপুরের মনে হয় পুরো পৃথিবী কাঁপছে। কাঁপুনির ভেতর মনে পড়তে থাকে তার স্বামী নাঈমের কথা, নাঈমের ভালো একটা চাকরির জন্য সুলতান ভাইয়ের কাছে সুপারিশ করার পর এখানে আসার কথা। নুপুরের হয়তো অতীত ও ভবিষ্যতের আরো অনেক কিছু মনে পড়ে। কিন্তু তখন আরো কয়েকবার কেঁপে উঠে তার পৃথিবী। ঝট করে নেমে যায় সুলতানের খসখসে পা।
পার্কে ছিল বাদামবিক্রেতা সাইদুর, ঘরে তার বউ পোয়াতি। ছিল টিকিট কাউন্টারে বসে থাকা আরাফাত, কদিন যাবৎ তার মায়ের ভীষণ অসুখ। আরো ছিল পার্কের একমাত্র রেস্টুরেন্টের মালিক কাম শেফ কাম ম্যানেজার সালমান, যার অনেক টাকা দরকার প্রেমিকার বিয়ে ঠেকানোর জন্য। “ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমিকম্প”—চিৎকার করে বলল সালমান। সালমানের চিৎকারেই যেন সম্বিত ফিরে পেল সবাই। এই কাঁপুনি যে তাদের ব্যক্তিগত নয়, অন্তর্গত নয় সেটা জানতে পেরে কিছুটা আশ্বস্ত হলো যেন। সাইদুর বলে উঠলো, “আমি তো ভাবছি আমার মাথা ঘুরান্টি দিতেছে, এর লাইগা বইসা পড়ছিলাম। বসার পরেও দেহি ঘুরানি থামে না।” কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসে আরাফাত। তার চেহারা দেখে মনে হয় ভয়ংকরভাবে রেগে আছে সে। “আল্লার গজব শুরু হইছে, আল্লার গজব। আকাম করার আর জায়গা পায় না মানুষজন।” গজগজ করে বলতে থাকে আরাফাত। তখনও থামেনি কম্পন।
কিছুটা ইতস্তত হয়ে লোহার জঞ্জাল থেকে বেরিয়ে আসে রাজু, তার পেছন পেছন সন্ত্রস্ত পারভিন। “ভূমিকম্প হইলে কী আর এই পার্কেই হইতেছে নাকি? পুরা শহরেই হওনের কথা।” আরাফতের বলা কথাটার পেছনে যোগ করে রাজু, কিছুটা দায়মুক্তির চেষ্টা। “কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি শুধু পার্কেই হচ্ছে। বাইরের সব শান্ত।” উত্তেজিত কণ্ঠে বলে সুলতান। নুপুর বড় করে মাথায় ঘোমটা দেয়ার চেষ্টা করছে যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে। “কি কন… কি কন, বাইরে সব শান্ত মানে?” আরাফাত বিভ্রান্ত হয়ে যায়। মহাকাশ থেকে ততক্ষণে নেমে এসেছে রিফাত, হাসিব ও জয়নাল। “ওইযে ওদিকে তাকান,” হাতের ইশারায় পার্কের সীমানার বাইরে থাকা একটা দোকান অথবা গাছ দেখাতে চায় সুলতান। ঘুটঘুটে অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখা যায় না। সালমানের রেস্টুরেন্টের টিমটিমে আলো দপ করে নিভে যায়, নিভে যায় টিনের কাউন্টারে ঝুলানো আশি ভোল্টেজের লাল বাত্তি। অসীম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায় পুরো পার্ক। বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পার্কের অধিবাসীদরে মনে হতে থাকে সুলতানের কথাই ঠিক। শুধু পার্কটাই দুলছে।
“এই মামা, পার্ক চলতেছে কেন?” ফিসফিস করে বলে হাসিব। “দুর ব্যাটা। আজকে বেশিই খাইছিস। পার্ক চলবে কেন? ভূমিকম্প হচ্ছে।” জয়নাল গলা নামিয়ে বলে। “আরে না, আসলেই চলতেছে পার্ক। এগিয়ে যাচ্ছে রেলের মতো। ওইদিকে তাকায়া দেখ বাড়িঘর গুলা কেমন সরে সরে যাচ্ছে।” নদীর ওপারের বাড়িঘরগুলোর দিকে ইশারা করে হাসিব। রিফাত ও জয়নাল একসাথে দেখে দৃশ্যটা। ছোট ছোট আলোকবিন্দু সরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেদের চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্বাস করতে পারে না তারা। অপেক্ষা করতে থাকে পার্কে থাকা অন্য মানুষরা কী বলে সেটা দেখার জন্য। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালায় সুলতান, নুপুরও। তাদের দেখাদেখি রাজুও জ্বালায় তার ফোনের ফ্ল্যাশ। খানিকটা আলোকিত হয়ে ওঠে পার্ক।
“এইযে কারেন্ট চলে গেছে। এখন আর পার্কে থাকা যাবে না। টিপাটিপি অনেক করিছেন। এখন সবাই বেরোন। পার্ক বন্ধ।” ঘোষণা দেয়ার মতো বলে আরাফাত। কেউ কোনো কথা না বলে পার্কের একমাত্র পথ যেটি প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য ব্যবহৃত হয় সেদিকে পা বাড়ায়। বাদামের ঝুড়িটা মাথায় তুলে নেয় সাইদুর। রেস্টুরেন্ট বন্ধ করতে উদ্যত হয় সালমান। ঠিক তখনি, যখন অন্ধকারে পারভিনের শরীরে আরেকবার হাত দিতে চায় রাজু, ঠিক তখনি, যখন নুপুরের শাড়ির কোনো এক ভাঁজে হাত চালিয়ে দেয় সুলতান, ঠিক তখনি, ঠিক তখনি চিৎকার করে উঠে রিফাত—“পানি পানি। পানি পানি।” রিফাতের জোড়া “পানি” চিৎকারে হতবুদ্ধ হয়ে যায় সবাই। নদীর পাড়ের পার্ক। তিনদিকে তো পানিই। তবুও এভাবে চিৎকার করার কী আছে। নুপুরের শাড়ির ভেতর হাত রেখেই সুলতান দেখতে পায় পার্কের সীমানার বাইরে থাকা গাছ ও দোকান অনেক দূরে চলে গেছে।
“হায় খোদা, পার্ক তো ভাসতেছে নদীতে। জমিন থিকা আলাদা হইয়া গেছে।” অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে আরাফাত। জমে একদম হিম হয়ে যায় পার্কের সবাই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে প্রত্যেকে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কী করবে। এবার অন্তর্গত পৃথিবী দুলে উঠতে থাকে সবার। রিফাত, হাসিব ও জয়নালের একত্রে মনে হতে থাকে রাত নয়টার আগে তাদের নিজ নিজ বাসায় উপস্থিত হওয়ার কথা। জহির স্যারের ব্যাচ শেষ হয় পৌনে নয়টায়। নয়টার ভেতর বাসায় থাকতে হয় তাদের। উচ্চমাধ্যমিকে পড়া তিন বন্ধু ইদানীং জহির স্যারের ব্যাচে না গিয়ে মহাকাশ ভ্রমণে আসে। আটটার দিকে পার্ক থেকে বের হয়ে চানাচুর, বুটমুড়ি কখনও বা ঘাসপাতা চাবিয়ে দূর করে মুখের দুর্গন্ধ। নয়টার আগ পর্যন্ত ঘুরঘুর করে শহরের অলিগলিতে। তারপর ঠিক নয়টায় উপস্থিত হয় বাসায়। তাদের পিতামাতা ও অভিভাবক স্থানীয় লোকেরা খুশি হয়। সন্তানদের সময়ানুবর্তিতার কথা বুক ফুলিয়ে প্রচারও করে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। পারভিনের মনে পড়ে তার মামার কথা। সাড়ে আটটার আগে বাসায় না ফিরলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন তিনি। খরস্রোতার বড়বাজারে লেডিস টেইলার্সে কাজ করে পারভিন, কাটিং মাস্টার। মাস শেষে গ্রামে টাকা পাঠায়। বড় মামা ও মামির বাসায় রাতে গিয়ে খানিকটা মাথা গুঁজে সে। রাজুর সাথে প্রেমের বয়স এক সপ্তাহ মাত্র। পাশের সেলুনের নরসুন্দর রাজু। গত সপ্তাহে শেষ দিকে এক হাজার টাকার নোট ভাঙতি করতে ভাই ভাই সেলুনে গিয়েছিল পারভিন। এত বড় নোট দেখে হেসেছিল রাজু। দোকানে তখন অন্য কেউ ছিল না। অনেকদিন চোখে চোখে রাখা মর্ডান টেইলার্সের মেয়েটাকে নিজের সেলুনে পেয়ে রাজু বলে ফেলেছিল বিশেষ একটি কথা। তৎক্ষণাৎ কিছু না জানালেও পারভিনও ঝুঁকে গিয়েছিল দুইদিনের মাথায়। সুলতানের মনে পড়ে ঢাকায় ফেলে আসা লাখ টাকার ডিল। একটা বায়িং হাউজ আছে তার। আগামীকাল সকালেই বিদেশি এক পার্টির সাথে তার মিটিং। ফুফাতো ভাইয়ের ফেসবুক আইডিতে তার বউয়ের ছবি দেখে মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সুলতানের। দিনের পর দিন বাজারের খাবার খেয়ে একটু ঘরের খাবার খেতে মনটা আনচান করে উঠেছিল তার। হাতভর্তি ফলমূল আর পকেটে হীরার লকেট নিয়ে চলে এসেছিল খরস্রোতায়। নুপুরকে লকেট পরাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে সুলতানের। মেয়েটা বড্ড স্বামীভক্ত। কোনোভাবেই ধরা দিতে চায় না। তবে সুলতানও ছেড়ে দেয়ার লোক না। নাঈমের জন্য একটা ভালো চাকরির কথা ওঠাতেই সুযোগটা নিয়ে নিয়েছে সে। নুপুরের চোখে তখন তৈরি হয়েছে হামহাম ঝরনা। কোনোকিছুই মনে করতে পারছে না সে, কিছুই চলছে না তার মাথায়। সালমান ভাবছে কিছু? না বোধহয়। আরাফাত অথবা সাইদুরও না। তারা বরং ভেসে গেলেই খুশি। জীবনের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে তারা ক্লান্ত। প্রতিদিন ছুটছে তারা, প্রতিদিন ডুবছে। খরস্রোতা নদীতে ভেসে যাওয়া পার্ক অন্তত একটুখানি ভাসিয়ে রাখছে তাদের।
পরদিন সকালে শহরের পত্রিকাগুলোর শেষ পাতায় অথবা ভেতরের গ্রাম বাংলার পাতায় ছোট্ট একটা খবর ছাপা হলো। খবরটা পড়া হলো না সুলতান, রাজু, রিফাত, হাসিব, জয়নাল, নুপুর, পারভিন, সালমান, আরাফাত ও সাইদুরের। খবর হয়ে যাওয়া মানুষেরা খবর পড়তে পারে না।
দুই.
খরস্রোতা নদীতে হঠাৎ পানির ঢল
গতরাত থেকে খরস্রোতা নদীতে হঠাৎ পানির ঢল লক্ষ করা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে পাশ্ববর্তী জেলার বাঁধ খুলে দেয়ার কারণেই এই বিপর্যয়। আকস্মিক পানি বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় মানুষজন। নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি ভাসমান পার্ক তলিয়ে গেছে পানিতে। হতাহতের সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।
0 Comments