এত লাশ কিভাবে হজম করবেন মাননীয়?

Published by hasanenam on

এত লাশ কিভাবে হজম করবেন মাননীয়? পাঁচদিন ইন্টারনেট ব্লাকআউটের পর সাধারণ মানুষ যখন শত শত মৃত্যুর খবর আর লাশের ছবি দেখছে, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশের গুলি করার ছবি দেখছে তখন ক্রোধে ফেটে পড়ছে তারা। এই লাশগুলোর নাম বাংলাদেশ। এই লাশগুলোই আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। আমি এই লেখাটা যখন লেখছি তখন প্রথম আলোর সূত্র মতে লাশ পড়েছে দুইশোর অধিক। শহীদদের ডাটাবেস তৈরির কাজ চলছে । পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ছাত্র জনতা এই কাজের আনজাম দিচ্ছে। ফলত, গত পাঁচদিন যে আশংকা আমরা করেছিলাম যে, লাশগুলো হজম করে ফেলা হবে; সেটি আর হচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধের পর এত বেশি রক্তপাত এই প্রথম। অনেকে মোটাদাগে বলছেন এটা হওয়ারই ছিল। হয়ত হওয়ারই ছিল। কিন্তু এটা যে অনিবার্য হয়ে উঠবে আই `হেইট পলিটিক্স জেনারেশন‘র হাত ধরেই সেটা অন্তত আমি কখনই ভাবিনি। গত নির্বাচনের পূর্বে তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তবে সেই পরিবেশ খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছিল আওয়ামীলীগ। দেশের  সাধারণ নাগরিক, বিরোধী দল, বিদেশী শক্তিসহ সবমহলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বাচন করেছিল তারা। কিন্তু ক্ষমতায় বসার কয়েক মাসের মধ্যে এরকম রক্তপাত হবে সেটা কেউ ভাবেনি। মাননীয় এখন যতই বলুক যে, `আমাদের আশংকা ছিল এমন কিছু হবে‘  এগুলো সব ডাহা মিথ্যা। আর যদি সত্যিও হয় তাহলে এটাই প্রমাণ হয় যে পূর্ব অনুমান থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি টাকা দিয়ে পোষা ইন্টেলিজেন্স, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছুই করতে পারেনি। তারা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ।

আমরা যারা এই আন্দোলনে একদম প্রথম দিক থেকে ছিলাম, তারা জানি সরকার কিভাবে আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। কিভাবে কোনো দাবিই গ্রাহ্য করেনি। আজকের এই সংলাপ সংলাপ বুলি আর সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়েছে বলে নাকি কান্না তাই আর কাজে আসছে না। সাধারণ ছাত্রদের যদি ব্যবহার করা হয়েই থাকে তাহলে সেই দায় সরকারকেই নিতে হবে। আমি নিজে সাক্ষী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক রাখার জন্য কী পরিমাণ কাঠখড় পুড়িয়েছে। শাহবাগের ভ্রাম্যমান ছোট্ট স্টেজ দখল করার জন্য এহেন কোনো ছাত্র সংগঠন নাই যে সেখানে যায়নি। এই আজকে যাদের নাম সবার মুখে মুখে, এই সার্জিস, নাহিদ, আসিফ, বাকের, রিফাতরা তখন কেবল আমাদের ক্যাম্পাসের ভাই ব্রাদার। এরা কখনও হাসিমুখে, কখনও রেগে, কখনও কৌশলে ছোট্ট ওই স্টেজটাকে রাজনীতিমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে। আন্দোলনটা শেষ হতে পারতো ওই ছোট্ট স্টেজেই। যদি বলি তারও আগে শেষ হওয়ার সুযোগ ছিল। এই আন্দোলন ঢাবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুলে সেটা এখন সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, শাহবাগ থেকে ছড়িয়ে গেছে পুরো দেশে।

এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল কতিপয় শিক্ষার্থীর নিজস্ব স্বার্থের আন্দোলন। যারা নিজের স্বার্থে, নিজের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করার জন্য নেমেছে। সরকার বিরোধী বুদ্ধিজীবী মহল এমনটাই বলছিল। এছাড়াও সিটিজেন ইন্টেলেকচুয়ালরা নতুন এক গালভরা গল্প হাজির করেছিল, সরকার নিজের বিভিন্ন ইস্যু ঢাকতেই ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়েছে। আমরা প্রটেস্ট শেষ করে রাতে বাসায় আসার পথে এসব শুনতাম। নিজেরাও বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম কখনও কখনও, আসলেই কী বড় কোনো ছকের অংশ হয়ে যাচ্ছি নাতো? এই গালভরা ছক আর হোয়াট এবাউটিজমেই আন্দোলনটা শেষ হতে পারতো। সরকার দাবি মেনে নিলে আমরা হয়ত কেবল সারাজীবন এই গিল্ট ফিলেই থাকতাম। আর বছর কয়েক পরপর বিভিন্ন আড্ডায়  শুনতে হতো যে, আমাদের ব্যবহার করে বড়সড় কোনো ইস্যু ধাপাচাপা দিয়েছিল সরকার।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর ফ্যাসিস্ট করে আরেক। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব স্বার্থে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন কোথায় গিয়ে ঠেকলো? যদি তৃতীয় কোন শক্তি এই আন্দোলনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে থাকে তাহলে সেটার সুযোগ কে করে দিলো? এসব হিসাব আমরা মিলাতে পারি। আমরা এগুলো মনে রাখবো। এই লাশের দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। তিনি কোনভাবেই এই দায় এড়াতে পারেন না। রাজাকারের বাচ্চা বলে আমাদের গালি না দিলে পরিস্থিতি কখনই এরকম হতো না।

গত কয়েকদিনে তার বক্তব্য যদি খেয়াল করে শুনে থাকেন তাহলে দেখবেন তিনি এখন কথায় কথায় দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু সারাদেশে নিহত হওয়া সাধারণ ছাত্র-জনতার কথা একবারও বলছেন না। তার কাছে এই লাশের মিছিলের থেকে বেশি দামি মেট্রোরেল। এ কারণে তিনি কোন শহীদ পরিবারকে দেখতে না গিয়ে মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শনে যান।  কালো শাড়ি পরে যেদিন ভাষণ দিলেন সেদিন সরকারি হিসাবেই ছয়টা লাশ পড়েছে। নিরস্ত্র আবু সাইদের উপর কুকুরের মতো গুলি চালিয়েছে পুলিশ। মাননীয় তার বক্তব্যে একটা বারের জন্যও সেই কথা উচ্চারণ করেন নাই। তিনি কেন এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেন বারবার কেবল রাষ্ট্রের ক্ষয়-ক্ষতির ফর্দ তুলে ধরছেন সেই কারণ খুব স্পষ্ট। তিনি মনে করছেন, এই লাশের মিছিল তিনি হজম করে ফেলবেন।

খুব সোজা বাংলায় বলতে চাই, মাননীয় আপনি এতবড় স্বৈরাচার এখনও হয়ে উঠেননি যে এতগুলো লাশ আপনি হজম করে ফেলবেন। আপনি পারবেন না। আমরা জেগে আছি। যদি আমাদেরও মেরে ফেলেন, আমার ভাইরা জেগে থাকবে। আপনার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে সবাই। আপনি এই লাশ হজম করতে পারবেন না। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে হজম করতে চান, তাহলে বমি হবে। রক্ত বমি….

সেই রক্তে ভেসে যাবেন আপনি নিজেই।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *